সুন্দরবনের শিবসা নদীর তীরে গাবগাছের বাগানটা যেন বিস্ময়
গহিন বন, চারদিকে ঘন গাছের সারি। সকালের রোদ যেন আঁচল বিছিয়েছে সুন্দরবনের বুকে। বনের শাকবাড়িয়া নদী ধরে ট্রলার এগিয়ে চলছে বন বিভাগের বজবজা টহল ফাঁড়ির দিকে। নিরাপত্তা দিতে সেখান থেকে ট্রলারে উঠলেন বনপ্রহরী মফিজুল ইসলাম। গন্তব্য সুন্দরবনের শিবসা নদীর পাড়ের গাবগাছের বাগান দেখা। ম্যানগ্রোভ এই বনে সুন্দরী, গেওয়া, গরানসহ শত শত প্রজাতির গাছ সচরাচর দেখা গেলেও গহিন বনে গাবগাছের বাগান দেখাটা বিস্ময়ের।
১৪ ফেব্রুয়ারি খুলনার সুন্দরবনঘেঁষা কয়রা উপজেলা থেকে বন বিভাগ পর্যটকদের ভ্রমণের অনুমতিপত্র দেওয়া শুরু করেছে। উদ্বোধনী দিনে যথাযথ নিয়ম মেনে রাজস্ব দিয়ে ভ্রমণকারী দলের সঙ্গী হয়েছেন এই প্রতিবেদক। সুন্দরবনে গাবগাছের বাগান দেখার ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতাই এখানে তুলে ধরা হয়েছে।
বনের মধ্যের ঝপঝোপিয়া ও আড়ুয়া শিবসা নদী দিয়ে এঁকেবেঁকে ট্রলার চলে যায় গহিন বনের শিবসা নদীতে। শান্ত শিবসা নদী ধরে চলতে থাকে ট্রলার। ট্রলারে বসে একটু খেয়াল করলে বনের ভেতরটা দেখা যায়। কেওড়া বনের নিচে ঝোপজঙ্গল কম। বনের ভেতরে তাকিয়ে দেখা গেল, হরিণ ও বন্য শূকরের দল ঘুরে বেড়াচ্ছে। বানরের পাল দৌড়ঝাঁপ করছে। ট্রলারে আলাপকালে সফরসঙ্গী বনপ্রহরী মফিজুল ইসলাম বললেন, ‘খাল বা নদীর ধারে দল বেঁধে হরিণের চলাফেরার দৃশ্য এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে।’
ঘণ্টাদুয়েক চলার পর শিবসা নদীর পাড়ে হঠাৎ নজর কাড়ল কিছুটা ব্যতিক্রম বন। দূর থেকেই দেখা গেল, বনের মধ্যে পুরোনো ইটের স্তূপ উঁচু হয়ে আছে। তার আশপাশে অসংখ্য গাবগাছ। কাছাকাছি পৌঁছাতেই চোখে পড়ে, জোয়ারের পানির তোড়ে ছোট বড় বেশ কয়েকটি গাবগাছ শিকড় উপড়ে পড়ে আছে নদীর পাড়ে। আর ইটের স্তূপের চারপাশে ঘিরে থাকা গাবগাছের বিশাল বাগানজুড়ে ডালে ডালে এসেছে নতুন পাতা।
ট্রলার থেকে নেমে আশপাশ ঘুরে দেখা যায়, গাবগাছের বাগানজুড়ে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য ইট। এখানে একসময় প্রাচীন স্থাপনা ছিল। এখন সেগুলো ধ্বংস হয়ে শুধু ইটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। সেখানে একসময় যে মোটা ইটের দেয়াল ছিল, সেটির প্রমাণ রয়েছে এখনো। নদীভাঙনে ওই প্রাচীন স্থাপনা ও গাবগাছের বাগানের কিছু অংশ বিলীন হয়ে গেছে। আশপাশের ইটগুলো জোয়ারের পানিতে প্রতিনিয়ত ভেসে যাচ্ছে। গাবগাছের বাগানের আশপাশে দেখা গেল বাঘের পায়ের চিহ্নের টাটকা ছাপ।
আগে এখানে অনেক বেশি গাবগাছ ছিল বলে জানালেন বনপ্রহরী মফিজুল ইসলাম। বললেন, এই এলাকা সুন্দরবনের অন্যান্য এলাকা থেকে অনেক উঁচু হওয়ায় এখনো গাবগাছগুলো বেঁচে আছে। এই গাবগাছের বাগানে বাঘের বিচরণ বেশি। এখানে কয়েক শ বছর আগে রাজাদের দুর্গ ছিল। ছড়িয়ে থাকা ইটগুলো সেই প্রাচীন স্থাপনারই ধ্বংসাবশেষ।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এম এ আজিজ তাঁর ‘সুন্দরবনের প্রাকৃতিক ইতিহাস’ বইয়ে লিখেছেন, শিবসা নদী-সংলগ্ন যে ধ্বংসাবশেষ বর্তমানে দেখা যায়, সেগুলো কমপক্ষে ৪০০ বছর আগে স্থাপিত হয়ে থাকতে পারে।’
শিবসা নদীর পূর্ব পাড়ে গাবগাছের বাগান রেখে কিছুটা দক্ষিণে এগোলেই পড়ে শেখের খাল। খালটির মধ্যবর্তী স্থানটি শেখের টেক নামে পরিচিত। সুন্দরবনের অভ্যন্তরে বাংলার মধ্যযুগীয় ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি মন্দির। বহু বছর ধরে মন্দিরটি লোকচক্ষুর আড়ালে থাকলেও, এখন তা পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করেছে বন বিভাগ। মোগল আমলে নির্মিত মন্দিরটি ঘিরে তৈরি করা হয়েছে শেখেরটেক ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র।
সুন্দরবন-সংলগ্ন কয়রা এলাকার বনজীবী জেলে মনোরঞ্জন মণ্ডল বলেন, সুন্দরবনের গাববাগানের সামনের শিবসা নদীতে জাল দিয়ে বেশ মাছ পাওয়া যায়। গাছ থেকে গাব পেড়ে তাঁরা জাল মেরামতেও ব্যবহার করেছেন। গাব থেঁতলে রস বের করে জালে ব্যবহার করলে জাল মজবুত হয়। তবে বাঘের আনাগোনা বেশি থাকায় গাববাগানের ইটের স্তূপের ওপর চলাচল করতে ভয় ভয় লাগে। উঁচু ইটের স্তূপের ওপর বাঘ বিশ্রাম নেয়। মাঝেমধ্যে বাচ্চাসহ বাঘকে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন তাঁরা।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, শিবসা নদীর পাড়ের গাবগাছের বাগান ও প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষটি বারো ভূঁইয়া বা মোগলদের সমসাময়িক সময়কালের বলে মনে করা হয়। ওই এলাকাটি বনের অন্যান্য স্থানের তুলনায় কিছুটা উঁচু হওয়ায় বাঘের আধিক্য বেশি। কয়েক বছর আগেও গাবগাছের বাগান ঘিরে বড় ইটের তৈরি সীমানাপ্রাচীর ছিল। নদীর ভাঙনে হারিয়ে গেছে সেটি। তবে নদীভাঙনের বিষয়টি প্রাকৃতিক।
Post Comment